তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে করা আপিলের শুনানি শেষ হয়েছে।
আগামী বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) রায় ঘোষণা করবেন আপিল বিভাগ। মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ-এর নেতৃত্বে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এই তারিখ নির্ধারণ করেন।
এর মধ্য দিয়ে বহু আলোচিত ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলার রায় ঘোষণার দিন ঠিক হলো—যার ফলাফল দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনব্যবস্থা ও সাংবিধানিক রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আট দিনব্যাপী শুনানি শেষ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে দায়ের করা আপিলের শুনানি শুরু হয় গত ২১ অক্টোবর, এবং মোট আটটি কার্যদিবস ধরে চলে।
শুনানির দিনগুলো হলো — ২২, ২৩, ২৮, ২৯ অক্টোবর এবং ২, ৪, ৫, ৬ নভেম্বর।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি শেষ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন,
“তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় সমাজে এমনভাবে কুঠারাঘাত করেছে, যা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। মৃত ব্যক্তি এসে রাতের ভোট দিয়েছে—এমন অস্বাভাবিক ঘটনা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে।”
মামলার পটভূমি ও ইতিহাস
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রথম সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।
তবে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম. সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বৈধ ঘোষণা করে রিট খারিজ করে দেয়।
পরে ২০০৫ সালে আবেদনকারীরা আপিল করেন, এবং ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে, যার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়।
এর পর ওই বছরই ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয় পঞ্চদশ সংশোধনী বিল, যার মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হয়।
পুনর্বিবেচনার আবেদন ও বর্তমান পরিস্থিতি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর, নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন।
তাদের সঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও আপিল করেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে যারা এই আবেদন করেছেন, তারা হলেন— তোফায়েল আহমেদ, এম. হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া, এবং জাহরা রহমান।
সবগুলো আপিলের শুনানি একত্রে নিয়ে আপিল বিভাগ রায়ের তারিখ ঘোষণা করেছে।
আইনজীবীদের বক্তব্য
আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া।
তিনি যুক্তি দেন যে, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনগণের আস্থা অর্জন করেছিল। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে কয়েকটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালে এটি বাতিল করে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনাস্থা বাড়ানো হয়েছে।”
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, “সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতার পরিবর্তন কেবলমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে হওয়া উচিত। অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন সাংবিধানিক ভারসাম্য নষ্ট করবে।”
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক রয়েছে।
বিএনপি ও তাদের জোট দলগুলো দাবি করছে, নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারই একমাত্র সমাধান।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মত, সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো অরাজনৈতিক সরকার গঠন করা গণতন্ত্রবিরোধী।
এই রায় ঘোষণার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা।
রায় ঘোষণার তারিখ ও তাৎপর্য
আগামী ২০ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করবে।
এ রায় শুধু একটি সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন ব্যবস্থার গতিপথ ও রাজনৈতিক আস্থার পরিবেশ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এক সিনিয়র আইনজীবী বলেন,
“এই রায়ের মাধ্যমে বোঝা যাবে—বাংলাদেশের নির্বাচনী কাঠামো আগামী দিনে কোন পথে যাবে। সংবিধান ও জনগণের আস্থার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে আদালতের মূল চ্যালেঞ্জ।”
সারসংক্ষেপ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে শুনানি শেষ হয়েছে
রায় ঘোষণা হবে ২০ নভেম্বর
শুনানি করেছেন সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ
আবেদনকারীরা: বদিউল আলম মজুমদার, মির্জা ফখরুল, মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ অনেকে
রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, ব্যবস্থা বাতিল সমাজে আঘাত করেছে
রায়ের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্কের আশঙ্কা
