দেশে শীতকালীন পর্যটন মৌসুম শুরু হয়েছে। বছরের এই সময়টিতে ভ্রমণপ্রেমীদের ভিড় সাধারণত সবচেয়ে বেশি থাকে। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, এ বছরও পর্যটকেরা সবচেয়ে বেশি ছুটছেন কক্সবাজার, সাজেক, রাঙামাটি এবং সুন্দরবনমুখী। তবে সেন্ট মার্টিনে দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা, আর সিলেট রুটের ভয়াবহ যানজট ও যোগাযোগব্যবস্থার কারণে দুই গন্তব্যেই ভ্রমণকারীর সংখ্যা কমেছে।
গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিধিনিষেধের কারণে পর্যটনে বড় ধস নামে। এবার পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক—এমন আশায় পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০২৪-২৫ মৌসুমে ভালো ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
বিভিন্ন স্থানে ছাড় ও অফার, প্যাকেজ নিয়ে প্রতিযোগিতা
পর্যটক আকর্ষণে দেশের হোটেল–মোটেল ও রিসোর্টগুলো নানা ধরনের ছাড় দিচ্ছে। সিলেট–শ্রীমঙ্গলের রিসোর্টগুলো সপ্তাহের দিন অনুযায়ী ২০–৫৫% পর্যন্ত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে।
- বালিশিরা রিসোর্ট ও নভেম ইকো রিসোর্ট: ২০–৩০% ছাড়
- গ্র্যান্ড সুলতান: ওয়েবসাইটে ৫৫% পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা
শ্রীমঙ্গলের প্রায় ২০০টিরও বেশি হোটেল–মোটেল ও রিসোর্টে হানিমুনসহ বিভিন্ন প্যাকেজ রয়েছে।
সাজেকেও চলছে জমজমাট অফার।
সেখানে মেঘকাব্য হিলটপ কটেজ, মেঘপল্লী, ডিমোর সাজেক ভ্যালি রিসোর্টসহ বেশিরভাগ স্থাপনায় ২০–৫০% ছাড় চলছে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনও পর্যটকদের জন্য ৩০% পর্যন্ত মূল্যছাড় দিচ্ছে।
সেন্ট মার্টিনে রাত্রিযাপন সীমিত, তাই ভাড়া বেশি
সেন্ট মার্টিনে গত ৯ মাসের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও এখন শুধুমাত্র দিনের বেলায় ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। ডিসেম্বর–জানুয়ারিতে সীমিত পরিসরে রাত্রিযাপন করা যাবে।
প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২ হাজার পর্যটক যেতে পারবেন। এরপর আবার দীর্ঘ ৯ মাসের নিষেধাজ্ঞা।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রাত্রিযাপনের সুযোগ কম থাকায় সেন্ট মার্টিনে হোটেল ও রিসোর্টের ভাড়া এবার বেশি হবে।
কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি চাপ
কক্সবাজারে প্রায় ৪৫০টিরও বেশি হোটেল–রিসোর্ট রয়েছে। ইতিমধ্যে ডিসেম্বর–জানুয়ারির বুকিং নিতে শুরু করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে ২০–৪০% ছাড় দেওয়া হলেও ডিসেম্বরের শেষদিকে ভিড় বাড়লে ছাড় কমে যেতে পারে।
কক্সবাজার হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন,
“গত মৌসুমে ভালো ব্যবসা হয়েছিল। এবারও পরিস্থিতি ইতিবাচক। বিশেষ করে সেন্ট মার্টিনে নির্দিষ্ট কোটা থাকায় কক্সবাজারে পর্যটক আরও বেশি চাপবে।”
সিলেটে পর্যটক কমছে—প্রধান কারণ দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা
সিলেটে সাধারণত শীত ও বর্ষায় পর্যটক বেশি থাকে, কিন্তু এবার পরিস্থিতি উল্টো।
কারণ—
- ঢাকা–সিলেট মহাসড়ক সংস্কারের কারণে ভয়াবহ যানজট
- ৪–৬ ঘণ্টার পথ এখন ১৬–১৮ ঘণ্টা
- সিলেট–তামাবিল মহাসড়কও খারাপ
- বিমানভাড়া অত্যধিক
- ট্রেনের টিকিট পাওয়া কঠিন
এসব কারণে সিলেটের হোটেল–মোটেলগুলোতে বুকিং কমে গেছে।
হোটেল অ্যান্ড গেস্টহাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন নেতা গোলাম কিবরিয়া বলেন,
“মৌসুম শুরু হলেও বুকিং আশানুরূপ নয়। যোগাযোগব্যবস্থা ঠিক না হলে এ মৌসুমেও ব্যবসায় বড় ধস নামবে।”
সুন্দরবনে পর্যটকের আগ্রহ বাড়ছে, বুকিং প্রায় শেষ
সুন্দরবনে রাত্রিযাপনের সুযোগ সীমিত হলেও পর্যটকের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি।
বর্তমানে ছোট–বড় ৬০টির মতো ক্রুজ–জাহাজে ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে।
২ রাত ৩ দিনের সুন্দরবন ট্যুর প্যাকেজ:
- খরচ: ১০–২০ হাজার টাকা
সি পার্লের বিপণন কর্মকর্তা এ কে এম আসাদুর রহমান জানান,
“ডিসেম্বর মাসের ৯০% বুকিং ইতিমধ্যে পূরণ।”
হাউসবোটের চাহিদাও বাড়ছে
দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০০টি হাউসবোট রয়েছে—এর মধ্যে ২৫০টির বেশি টাঙ্গুয়ার হাওরে, বাকিগুলো কাপ্তাই হ্রদ, পদ্মা নদী ও অন্যান্য এলাকায়।
খরচ (প্রতি ব্যক্তি):
- টাঙ্গুয়ার হাওর: ৪,০০০–১২,০০০ টাকা
- কাপ্তাই হ্রদ: ৩,০০০–৮,৫০০ টাকা
- পদ্মা নদী: ১,৫০০–৩,৫০০ টাকা
হাউসবোট অ্যাসোসিয়েশন জানায়, সড়কের বেহাল পরিস্থিতির কারণে গত কয়েক মাস পর্যটক কম হলেও এখন শীত মৌসুম ফেরত আনার চেষ্টা চলছে।
বিদেশি পর্যটক কম—বাধা ভ্যাট ও বিধিনিষেধ
বিদেশি পর্যটক এখনও তুলনামূলক কম।
কারণ—
- ভ্রমণ বাজেটের ওপর ১৫% ভ্যাট
- দক্ষ ট্যুর গাইডের ঘাটতি
- পার্বত্য অঞ্চলে নানা নিষেধাজ্ঞা
রয়েল বেঙ্গল ট্যুরস জানায়,
২০২৩–২৪ অর্থবছরে যেখানে মুনাফা ছিল ১১ লাখ টাকা, ২০২৪–২৫ সালে তা নেমে এসেছে ৭ লাখে।
নির্বাচন ঘিরে দ্বিধা ও প্রত্যাশা
ব্যবসায়ীরা মনে করেন—পর্যটন খাত মূলত তিন বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল:
১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
২. নিরাপত্তা
৩. যোগাযোগব্যবস্থা
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ায় অনেকেই সম্ভাব্য অস্থিরতার শঙ্কা করছেন। আবার অনেক প্রবাসী নির্বাচনের সময় দেশে ফিরবেন, যা পর্যটনে ইতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে।
