মানুষ স্বভাবগতভাবে দুর্বল—এই দুর্বলতা থেকেই আমাদের প্রয়োজন হয় সর্বশক্তিমান আল্লাহর সহায়তা। নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবিদের এমন এক দোয়া শিখিয়েছিলেন, যা মানুষকে অবিশ্বাস, দারিদ্র্য এবং কবরের শাস্তির মতো ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। দোয়া সংক্ষিপ্ত হলেও এর অর্থ অত্যন্ত গভীর।
দোয়ার প্রেক্ষাপট
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবিদের এই দোয়া নিয়মিত পড়ার তাগিদ দিতেন, বিশেষ করে সালাতের পর, সকাল-সন্ধ্যায় ও যখন মনে ভয় বা অস্থিরতা দেখা দিত। বর্ণনায় এসেছে যে তিনি প্রায়ই এই দোয়া পাঠ করতেন—
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল কুফরি, ওয়াল ফাকরি, ওয়া আউজুবিকা মিন আযাবিল কবর।”
এই দোয়া মানুষকে তিনটি বড় বিপদ থেকে আল্লাহর হেফাজতে রাখার শিক্ষা দেয়।
কুফর কী?
‘কুফর’ শব্দের আদি অর্থ হলো ঢেকে ফেলা বা অস্বীকার করা। ইসলামী পরিভাষায় এর মানে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ব, বিধান বা রাসুল (সা.)-এর সত্যতা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করা।
কোরআনে আল্লাহ বলেন—
“যারা কুফরি করে, তাদের আমল ধূলিকণার মতো বিলীন হয়ে যায়।” (সুরা ইবরাহিম: ১৮)
আরেক আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে—
“যে কেউ ইমানের পর কুফরি করে, সে সরল পথ থেকে দূরে সরে গেল।” (সুরা নিসা: ১৩৭)
কেন কুফর থেকে আশ্রয় চাওয়া জরুরি
১. ইমান হারালে জীবন ধ্বংস হয় — উদ্দেশ্য, মূল্যবোধ ও আখিরাতের ভবিষ্যৎ সবই বিপন্ন হয়ে পড়ে।
২. নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয় — আল্লাহভীতি চলে গেলে পাপ সহজ হয়ে যায়, হৃদয় কঠিন হয়ে যায়।
৩. পরিণতি ভয়াবহ — কোরআনে কুফরির শাস্তি হিসেবে জাহান্নামের আগুনের কথা উল্লেখ আছে।
এই কারণেই নবীজি (সা.) প্রথমেই কুফর থেকে আশ্রয় চাইতেন।
দোয়ার শিক্ষণীয় দিক
১. ইমান রক্ষা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার — এই দোয়া শেখায়, মানুষকে প্রথমেই ইমান নষ্ট হওয়ার ভয় থেকে বাঁচতে হবে।
২. দারিদ্র্য থেকে রক্ষা — চরম অভাব অনেক সময় মানুষের ঈমান দুর্বল করে দেয়। ইবন কাসির ব্যাখ্যা করেন: “দারিদ্র্য অনেককে পরীক্ষায় ফেলে অস্থির করে তোলে।”
৩. কবরের শাস্তি থেকে আশ্রয় — দোয়ার শেষাংশ মনে করিয়ে দেয় দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, প্রকৃত নিরাপত্তা আখিরাতেই।
নবীজি (সা.)–এর আরেক দোয়া
সহিহ মুসলিমে এসেছে—
“হে আল্লাহ, আমি তোমার আশ্রয় চাই কুফর, ঋণ, পাপ ও দারিদ্র্য থেকে।” (হাদিস: ২৭০৬)
এ থেকে বোঝা যায়, ঈমান নষ্ট হওয়ার ভয় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল।
আধুনিক যুগে দোয়ার গুরুত্ব
আজ কুফর কেবল মুখের অস্বীকার নয়; এটি দেখা দেয় নানা রূপে—
- ধর্মকে উপহাস করা,
- পাপকে স্বাভাবিক বলা,
- আল্লাহর নির্দেশের অবহেলা,
- আধুনিকতার নামে ধর্ম থেকে দূরে সরে যাওয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বাসী মানুষ মানসিকভাবে বেশি স্থিতিশীল থাকে, কারণ তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে (Koenig, Oxford University Press, 2012)।
এই দোয়া সেই মানসিক ও আধ্যাত্মিক সুরক্ষা দেয়, যা মানুষকে ধীরে ধীরে অবিশ্বাসের দিকে যাওয়ার পথ থেকে ফিরিয়ে আনে।
দোয়ার অর্থ
“হে আল্লাহ, আমি তোমার আশ্রয় চাই কুফর (অবিশ্বাস) ও দারিদ্র্য থেকে এবং কবরের শাস্তি থেকে।”
(সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৫৪৬৫)
এতে বুঝা যায়, নবীজি (সা.) শুধু অবিশ্বাস নয়—অবিশ্বাসের দিকে নিয়ে যেতে পারে এমন সব পরিস্থিতি থেকেও আশ্রয় চাইতেন।
শেষ কথা
এই দোয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য দৈনন্দিন জীবনে পড়া অত্যন্ত জরুরি। এটি ইমানকে শক্ত রাখে, গাফেলতাকে দূর করে এবং দারিদ্র্য, হতাশা ও কবরের শাস্তি থেকে নিরাপত্তা দেয়।
আসুন আমরা সবাই নিয়মিত এই দোয়া পড়ি এবং নিজেদের ঈমান রক্ষায় সতর্ক থাকি।
