সকালের আলো ফুটতেই দেখা গেল মৃত্যুর মিছিল
সবে সকাল হয়েছে। গোবিন্দপুর গ্রামের পাশে জমে থাকা জলমগ্ন স্থানে ভাসছে অসংখ্য মৃত হাঁস।
হাঁস খামারি চেরাগ আলী পানিতে নেমে মৃত হাঁসগুলো তুলে আলে জমা করতে করতে ভেঙে পড়লেন কান্নায়।
চোখ ভিজে ওঠে আশপাশের মানুষেরও।
চেরাগ আলীর কণ্ঠে হতাশার আর্তনাদ—
“এই হাঁসগুলাই আমার জমা–পুঁজি আছিল। কত যতন করে পালছিলাম। বিষ খাইয়া সব মাইরা ফেলল। আমি নিঃস্ব হই গেলাম।”
১৪ বছরের হাঁস পালন, একদিনেই শেষ
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ৬৫ বছরের চেরাগ আলী প্রায় ১৪ বছর ধরে হাঁস পালন করেন।
তার খামারে ছিল ৫০০ দেশি হাঁস—
- কিছু ডিম দিত
- বাকিগুলো অচিরেই ডিম পাড়া শুরু করত
কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ৩৩৫টি হাঁস মারা যায়।
জলমগ্ন “গোবিন্দপুর জাওর” নামের নিচু জমিতে খাবার খুঁজতে নেমেছিল হাঁসগুলো।
সেখানেই অপেক্ষা করছিল বিষমাখা ধান।
বিকেলে ফিরে এসে দেখলেন মৃত্যুর স্তূপ
প্রতিদিনের মতো সকালে হাঁসগুলো ছেড়ে চেরাগ আলী জমিতে বোরো ধানের বীজতলা তৈরিতে যান।
বিকেলে ফিরে দেখেন—
- হাঁসের মৃতদেহ ভাসছে
- জমির আলে ছড়ানো সন্দেহজনক ধান
- আরও কয়েকটি হাঁস শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছে
আলো কমে যাওয়ায় সেদিন আর মৃত হাঁস তুলতে পারেননি।
রাতে কয়েকটি হাঁস অসুস্থ হয়ে যায়।
তেঁতুলের রস খাইয়ে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি।
চেরাগ আলীর ধারণা: উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিষ ছড়ানো হয়েছে
চেরাগ আলীর ভাষ্য—
“জলাশয়ের ধারে কেউ বিষ মেশানো ধান ছিটাইছে। সেই ধান খাইয়া আমার হাঁস মারা গেছে। কে বা কারা ছিটাইছে, দেখি নাই। কিন্তু এটা পরিকল্পিতভাবে করা হইছে।”
তিনি জানান—
- ৫ মাস আগে কিশোরগঞ্জ থেকে ৪০০ বাচ্চা হাঁস কিনেছিলেন
- সব বড় হয়ে ডিম দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল
- একদিনে সব শেষ হয়ে গেছে
তার ক্ষতির পরিমাণ লক্ষাধিক টাকা।
জলমগ্ন স্থানের ইতিহাস: বর্ষায় মাছ, শুকনো মৌসুমে ইজারা
“গোবিন্দপুর জাওর” এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তির জমি রয়েছে।
প্রতি বছর—
- বর্ষায় জমিগুলো পানিতে ডুবে মাছের আবাসস্থল হয়
- শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রেখে মাছ ধরার জন্য ইজারা দেওয়া হয়
এ বছর মফিজ আলীসহ কয়েকজন এই জলাশয় ইজারা নিয়েছেন।
তারা মাছ ধরা শেষ করে পানি ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
চেরাগ আলীর দাবি—
মাছ শিকারের সুবিধার জন্য কেউ হাঁস মারার উদ্দেশ্যে বিষ ছড়াতে পারে।
এলাকার মানুষের ধারণা—হাঁসই ছিল লক্ষ্য
প্রতিবেশী ফয়জুর রহমান, আবদুস সামাদসহ কয়েকজন জানান—
শীতের শুরুতে হাকালুকি হাওরের বিভিন্ন জলাশয়ে পরিযায়ী পাখি শিকার করতে অনেক সময় দুর্বৃত্তরা বিষ ছড়ায় বা জাল পাতে।
কিন্তু গোবিন্দপুরের জলাশয় তো এখন পুরো শুকনো!
তাদের মতে—
“এখানে পাখি আসে না। তাই পাখির জন্য বিষ ছড়ানো হয়নি। উদ্দেশ্য ছিল হাঁস মারা।”
তারা ঘটনাটিকে অমানবিক ও ঘৃণ্য বলে উল্লেখ করেন এবং অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানান।
ইজারাদারের অস্বীকৃতি
“গোবিন্দপুর জাওর”-এর ইজারাদার মফিজ আলী মোবাইলে জানান—
“এই ঘটনার বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। কয়েক দিন ধরে অন্য একটি বিলে মাছ ধরায় ব্যস্ত আছি।”
আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস পুলিশের
জুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মুরশেদুল আলম ভূঁইয়া বলেন—
“ঘটনা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছি। প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
চেরাগ আলী এ ঘটনার বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এক খামারির জীবন–সংগ্রাম, আর এক রাতেই সব শেষ
৩৩৫টি হাঁসের মৃত্যু শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়—
এক খামারির ১৪ বছরের পরিশ্রম ও স্বপ্নের মৃত্যু।
গ্রামের অনেকেই চেরাগ আলীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কিন্তু তার চোখের জলের কোনো দাম নেই।
বয়স্ক এই মানুষটি বলেন—
“ডিম বেচিয়া সংসার চলতো। এখন কেমনে চলমু? সব শেষ হয়ে গেল।”
এই ঘটনাটি শুধু একটি গ্রামের ঘটনা নয়—
বরং দেশজুড়ে ছোট খামারিদের অসহায় অবস্থার প্রতিচ্ছবি।
