বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো বিস্তৃত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নানা অভিযোগে সমালোচনার মুখে থাকা হাসিনা দাবি করেছেন, তার শাসনামলে পরিচালিত কুখ্যাত গোপন কারাগার, বিনা বিচারে আটক এবং দমন-পীড়নের বিষয়ে তিনি জানতেনই না। যদিও জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে নিহত ১৪ শতাধিক ছাত্র-জনতার ওপর চালানো সহিংসতার কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ছিলেন তিনিই।
ইমেইল সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে হাসিনা বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা বিচারবহির্ভূত হত্যার কোনো দায় তার নেই।
গোপন কারাগারের অস্তিত্ব প্রকাশ্যে আসে হাসিনার পতনের পর
বিবিসির অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারের পতনের পর সারাদেশে একাধিক গোপন কারাগারের সন্ধান পাওয়া যায়, যেখানে বছরের পর বছর কোনোরূপ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই মানুষকে আটকে রাখা হতো। সেখানে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম, রাজনৈতিক কর্মী মাইকেল চাকমাসহ অনেকেই।
তবে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ বহু নিখোঁজ ব্যক্তির এখনো কোনো খোঁজ মেলে না।
এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শেখ হাসিনা একই উত্তর দেন—তিনি নাকি এসব সম্পর্কে জানতেন না।
শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু হয় সহিংসতা, বিস্ফোরিত হয় জনরোষ
২০২৩ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে। কিন্তু সরকার ছাত্রলীগকে মাঠে নামালে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর পরে শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ মন্তব্য শিক্ষার্থীদের তীব্র ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারি দলের সশস্ত্র কর্মীদের ব্যবহার করা হয়। রাজপথে যখন রক্ত ঝরছিল, তখন আন্দোলনকারীদের দমনে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিল তৎকালীন সরকার।
শেষ পর্যন্ত আন্দোলন সরকার পতনের রূপ নেয়, এবং জনরোষের মুখে হাসিনা দেশ ছাড়েন। তার সঙ্গে পালিয়ে যান অনেক মন্ত্রী-এমপি ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
জাতিসংঘ: নিহত ১৪০০-এর বেশি, আহত হাজার হাজার
জাতিসংঘের OHCHR প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে ১৪০০ এরও বেশি মানুষ নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা গুরুতর আহত হন, অনেকে স্থায়ীভাবে অন্ধ বা পঙ্গু হয়ে যান। র্যাব ও পুলিশ গ্রেপ্তার করে ১১ হাজার সাতশর বেশি মানুষকে।
জাতিসংঘ বলেছে, এই অভিযানের কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল শেখ হাসিনার।
বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে আসে ‘প্রাণঘাতী শক্তি’ ব্যবহারের নির্দেশ
বিবিসির হাতে আসা একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং যাচাই করে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, আন্দোলন চলাকালে শেখ হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনীকে অনুমতি দেন বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের। নির্দেশনায় বলা হয়, আন্দোলনকারী যেখানেই মিলবে, সেখানেই গুলি করা হবে।
ট্রাইব্যুনালে বিচার, রায় আসছে ১৭ নভেম্বর
এ অভিযোগগুলোর ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা চলছে। আগামী ১৭ নভেম্বর রায় দেওয়ার কথা রয়েছে।
তবে হাসিনা এসব বিচারকে বলেছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাজানো, পক্ষপাতদুষ্ট ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের প্রহসন’।
১৫ বছরে ১৬৭৬টি গুমের অভিযোগ, পাওয়া গেছে আটটি গোপন কারাগার
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা গুম তদন্ত কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ পর্যালোচনা করা হয়েছে। তদন্তে দেশের বিভিন্ন স্থানে আটটি গোপন কারাগারের চিহ্ন পাওয়া যায়, যা পরিচালনা করত DGFI, RAB এবং CTTC।
হাসিনার মন্তব্য, ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতা তার নেই, তবে কোনো কর্মকর্তার অপব্যবহার থাকলে তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হওয়া উচিত।
