দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে ৫ নভেম্বর থেকে। সমন্বিত ইসলামি ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পরিসমাপ্তি ঘটেছে পাঁচটি ইসলামি ব্যাংকের পৃথক অস্তিত্বের। অনিয়ম, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছ ঋণ বিতরণ এবং অস্থির আর্থিক অবস্থার কারণে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় থাকা এই ব্যাংকগুলো শেষ পর্যন্ত একীভূত হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প পায়নি।
যেসব ব্যাংকের একীভূত কার্যক্রম শুরু হয়েছে, সেগুলো হলো সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ও বড় প্রতিষ্ঠান ছিল সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক: তিন দশকের পথচলার সমাপ্তি
১৯৯৫ সালে সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি পরে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক নামে পরিচিত হয়। ২২ নভেম্বর ১৯৯৫ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা ব্যাংকটি ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হলেও শেষ কয়েক বছরে ঋণখেলাপি ও আর্থিক অনিয়ম চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
৩১ মার্চ ২০২৪-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৮ শতাংশ। আর্থিকভাবে অন্যতম পুরোনো এই ইসলামি ব্যাংক তাই শেষ পর্যন্ত একীভূত কাঠামোর ভেতর চলে যেতে বাধ্য হয়।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: উচ্চ খেলাপি ঋণে ভরাডুবি
১৯৯৯ সালে কার্যক্রম শুরু করা এই ব্যাংকও দেশের ইসলামি ব্যাংকিং খাতে বড় নাম ছিল। প্রাথমিকভাবে শক্তিশালী উদ্যোক্তা ও মূলধনে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য দুর্বল হতে থাকে।
২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৭ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণ ও ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটিকে অকার্যকর তালিকায় ঠেলে দেয়।
এক্সিম ব্যাংক: ভালো অবস্থান থেকেও ধস
এক্সিম ব্যাংক ছিল এই পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে তুলনামূলকভাবে সুস্থ। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটি ধারাবাহিকভাবে ভালো অবস্থান ধরে রাখে। ২০২৪ সালের মার্চে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ছিল মাত্র ৬ শতাংশ, পরিমাণ ৩ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণের ঘোষণার পর ব্যাংকটি হঠাৎ সংকটে পড়ে। অনেক দক্ষ কর্মকর্তা চাকরি পরিবর্তন করেন, ফলে ব্যাংকের কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সমন্বিত ব্যাংক কাঠামোয় যুক্ত হতে বাধ্য হয়।
ইউনিয়ন ব্যাংক: ৯০ শতাংশ খেলাপি ঋণে কার্যত অচল
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাংক শুরু থেকেই নানা বিতর্ক ও অনিয়মে ঘেরা ছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যাংকটির মালিকানা, ঋণ বিতরণ এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন ছিল।
২০২৫ সালের মার্চে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ মোট ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকার প্রায় পুরো ঋণই অপ্রত্যাবর্তনযোগ্য হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখার কোনো বাস্তবসম্মত পথ ছিল না।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: বিদেশি উদ্যোক্তার ব্যাংক থেকে লুটপাটের ঘাঁটি
২০১৩ সালে প্রবাসী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি বড় প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোক্তাদের দ্বন্দ্ব, অস্বচ্ছ লেনদেন এবং দায়বদ্ধতার ঘাটতিতে ব্যাংকটি প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছে যায়।
প্রতিষ্ঠার এক দশকের মাথায় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৬০ শতাংশে দাঁড়ায়। প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার এই বিপুল খেলাপি ব্যাংকটিকে পুরোপুরি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ঠেলে দেয়।
আর্থিক অনিয়মের দায়ে অবসান
দেশের এই পাঁচটি ইসলামি ব্যাংক বহু বছর ধরে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও স্বচ্ছতার অভাবে ক্রমান্বয়ে সংকটে পড়ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন বিভিন্ন সতর্কতা, পর্যবেক্ষণ ও পুনর্গঠন প্রচেষ্টা চালালেও কার্যকর ফল না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত একটি সমন্বিত কাঠামো গঠন করা হয়।
একীভূত ব্যাংকের মাধ্যমে এখন একটি শক্তিশালী ও সুদৃঢ় ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই পাঁচ ব্যাংকের পৃথক অস্তিত্ব এখানেই শেষ।
