প্রিয় মানুষের কথা মনে পড়লে চোখ ভিজে যায়, প্রিয় বইয়ের পাতা উল্টালে মন ভালো হয়ে যায়। ভালোবাসা এমনই—যাকে ভালোবাসি, তার সঙ্গে সময় কাটাতে চাই, তার কথা শুনতে চাই, তাকে জানতে চাই। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা ছিল কোরআন। তাঁর পুরো জীবনই এর সাক্ষ্য বহন করে।
🌙 রাতের গভীরে কান্নাভেজা তিলাওয়াত
রাত যখন নিস্তব্ধ, মানুষ ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন নবীজি (সা.) দাঁড়াতেন নামাজে। ধীরে ধীরে কোরআন তিলাওয়াত করতেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে যে তাঁর পা ফুলে যেত। কখনো একটি আয়াত পড়তে পড়তে থেমে যেতেন, ভাবতেন, কাঁদতেন, আবার পড়তেন—যতক্ষণ না তাঁর দাড়ি অশ্রুতে ভিজে যেত।
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৭৬৩)
ভাবুন, যাঁর কাছে জিবরাইল (আ.) কোরআনের ওহি নিয়ে আসতেন, তিনিই সেই কোরআন পাঠ করে কাঁদছেন! এর চেয়ে গভীর ভালোবাসা আর কী হতে পারে?
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যারা কিতাব পাঠ করে, নামাজ কায়েম করে এবং আমি যা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে, তারা এমন এক ব্যবসার আশা করে, যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।”
(সুরা ফাতির, আয়াত: ২৯)
🎧 অন্যের কণ্ঠে কোরআন শোনার আনন্দ
ভালোবাসা শুধু বলার বিষয় নয়, তা অনুভবেরও বিষয়। নবীজি (সা.) কোরআন শুনতেও ভালোবাসতেন। একবার তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে বললেন,
“আমাকে কোরআন পড়ে শোনাও।”
ইবনে মাসউদ (রা.) অবাক হয়ে বললেন, “আপনার কাছে তো কোরআন নাজিল হয়েছে!”
নবীজি (সা.) বললেন, “আমি অন্যের মুখে শুনতে ভালোবাসি।”
যখন তিনি সুরা নিসার ৪১ নম্বর আয়াতে পৌঁছালেন—যেখানে বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন প্রতিটি উম্মতের সাক্ষী ডাকা হবে—তখন নবীজি (সা.)-এর চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। তিনি বললেন, “যথেষ্ট, থামো।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০৫০)
এই ছিল নবীজির কোরআনের প্রতি ভালোবাসা—তিনি শুধু পড়তেন না, শুনতেও উপভোগ করতেন।
📖 কোরআন শেখানোর ভালোবাসা
যাকে সত্যি ভালোবাসি, তার কথা অন্যদের জানাতে ইচ্ছা করে। নবীজি (সা.) কোরআন শেখাতেন অসীম ধৈর্য ও কোমলতায়। তিনি বলেছেন,
“তোমাদের মধ্যে সেরা সেই ব্যক্তি, যে কোরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০২৭)
অর্থাৎ, কোরআন শুধু তিলাওয়াত নয়—বোঝা, শেখা, এবং শেখানোই হলো প্রকৃত ভালোবাসার প্রকাশ।
💫 জীবন্ত কোরআনের রূপ
আয়েশা (রা.) নবীজি (সা.)–এর চরিত্র সম্পর্কে বলেছিলেন,
“তাঁর চরিত্রই ছিল কোরআন।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭৪৬)
ক্ষমা, ধৈর্য, দান—কোরআন যা শিক্ষা দেয়, নবীজি (সা.) তা-ই বাস্তবায়ন করেছেন। হাফিজ ইবনুল কাইয়িম (রহ.) লিখেছেন,
“রাসুল (সা.)-এর জীবন দেখলে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন কোরআনের জীবন্ত রূপ।”
(জাদ আল-মাআদ, ১/২৪৭)
তিনি সফরে থাকলেও কোরআন থেকে দূরে থাকতেন না। উটের পিঠে, হাঁটতে হাঁটতে, যেখানেই থাকুন না কেন—তাঁর মুখে থাকত কোরআনের তিলাওয়াত।
🌿 আমাদের জন্য শিক্ষা
কোরআন আল্লাহর বার্তা, মানবজীবনের দিকনির্দেশনা। অথচ আমরা অনেকেই সেটি শুধু সুন্দর কাভারে মুড়ে রাখি, পড়ি না, বুঝি না, মানি না। অথচ নবীজি (সা.) কোরআনকে জীবনের অংশ বানিয়েছিলেন।
তিনি বলেছেন,
“যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পড়ে, তার জন্য একটি নেকি, আর প্রতিটি নেকি ১০ গুণ হিসেবে।”
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৯১০)
আজ থেকেই শুরু করা যাক—প্রতিদিন একটি আয়াত, একটি পৃষ্ঠা, অথবা একটি সুরা। কোরআন শুধু একটি গ্রন্থ নয়—এটি জীবন পরিবর্তনের চাবিকাঠি।
ফজরের পর সুরা ইয়াসিন, মাগরিবের পর সুরা ওয়াকিয়া, আর এশার পর সুরা মুলক পাঠের অভ্যাস করুন। দেখবেন, মন প্রশান্ত হবে, জীবন হবে আলোকিত।
💖 ভালোবাসার পথ
যার ওপর কোরআন নাজিল হয়েছে, তিনি কোরআনকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন। আমরা যদি সত্যিই নবীজি (সা.)–কে ভালোবাসি, তবে তাঁর প্রিয় জিনিস—কোরআন—কেও ভালোবাসতে হবে।
আজই শুরু করুন—একটি সুরা, একটি পৃষ্ঠা, একটি আয়াত দিয়ে।
ভালোবাসা এখান থেকেই শুরু।
